সরকারি প্রকল্প অর্থায়নে সুকুকের সম্ভাবনা

Mezbah Uddin Ahmed

10/25/20241 min read

সুকুক এক ধরণের বিনিয়োগ পত্র যার গঠন ও বাস্তবায়নে শরিয়াহ পরিপালন নিশ্চিত করা হয়। বর্তমান বিশ্বের আর্থিক জগতে সুকুক সুপরিচিত। তবে, কোনো বিনিয়োগ পত্রের শরিয়াহ সম্মত হওয়ার জন্য এর নামকরণ সুকুক হওয়া প্রয়োজন নেই। শরিয়াহ সম্মত হওয়ার ক্ষেত্রে নামকরণের পরিবর্তে এর গঠন ও বাস্তবায়নের বিষয়গুলো বরং প্রাসঙ্গিক। অর্থাৎ, সুকুক একদিকে যেমন একটি বিশেষ্য, অন্য দিকে এটি একটি বিশেষণ। ২০০১ থেকে এখন পর্যন্ত আনুমানিক ৪০টি দেশ থেকে দুই ট্রিলিয়ন ডলার সমমূল্যের সুকুক ইস্যু করা হয়েছে। এর প্রায় অর্ধেক সার্বভৌম/সরকারি সুকুক, যার মধ্যে মুসলিম প্রধান দেশগুলো ছাড়াও অন্যান্য দেশ রয়েছে। যেমন, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ আফ্রিকা।

বর্তমান সময়ে সুকুকের প্রচলন শুরু হয়েছে প্রচলিত বন্ডের শরিয়াহ সম্মত একটি বিকল্প হিসেবে। প্রচলিত বন্ডগুলো সুদ-ভিত্তিক হওয়াতে ইসলামিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো (যেমন, ইসলামিক ব্যাংক, ইসলামিক বীমা/তাকাফুল ও শরিয়াহ ফান্ড) ও শরিয়াহ পরিপালনে ইচ্ছুক এমন ব্যক্তিগণ এতে বিনিয়োগ করতে পারে না। অন্য দিকে সুকুকে ইসলামিক বিনিয়োগকারীরা ছাড়াও প্রচলিত সব ধরণের বিনিয়োগকারীরা ও যে কোনো ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যক্তিরা বিনিয়োগ করতে পারে। অর্থাৎ, প্রচলিত বন্ডগুলো যেখানে এক শ্রেণীর বিনিয়োগকারীর জন্য বিনিয়োগ যোগ্য নয়, সুকুক সেখানে সবার জন্য বিনিয়োগ যোগ্য। ফলে, সুকুক ইস্যু করার মাধ্যমে ইস্যুকারী অধিকতর সংখ্যক বিনিয়োগকারীকে আকৃষ্ট করতে পারে। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ইস্যুকৃত প্রথম দুইটি সুকুকে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ করার সুযোগ ছিল। পরবর্তী সুকুকগুলোতে ইসলামিক ব্যাংকিংকে অগ্রাধিকার দেয়ার লক্ষ্যে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোকে শর্তসাপেক্ষে বিনিয়োগের সুযোগ প্রদান করা হয়।

বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ইস্যুকৃত সরকারি সুকুকগুলোর অভিজ্ঞতার আলোকে নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে এই ধরণের সুকুকের ব্যাপক চাহিদা বিদ্যমান। সুকুকগুলোর প্রতিটির রেট অফ রিটার্ন প্রচলিত ট্রেজারি বিল/বন্ড থেকে অনেক কম হওয়া সত্ত্বেও প্রতিটি কয়েক গুণ বেশি সাবস্ক্রাইব হয়েছে। ব্যাংক ব্যবস্থার বাহিরে অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি পর্যায়ে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধকরণে কোনো ধরণের পদক্ষেপ না নেয়া সত্ত্বেও এমন অসাধারণ সাড়া পাওয়া গেছে। এই থেকে সহজে অনুমেয় যে সুকুকে বিনিয়োগ উদ্বুদ্ধ করণে পদক্ষেপ নিলে সাড়া আরো বেশি হত।

চারটি সুকুকের মাধ্যমে সরকার মোট ১৯,০০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে, যা জুন ২০২৪-এ অভ্যন্তরীণ সরকারি দায়ের স্থিতির মাত্র ২.১১ শতাংশ। অথচ, সুনির্দিষ্ট ভাবে সুকুকে বিনিয়োগ চাহিদা আছে প্রতিটি ইসলামিক আর্থিক সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ও বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠী থেকে। বাংলাদেশে বিদ্যমান ১০টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামিক ব্যাংক, ৩০টি প্রচলিত ব্যাংকের ব্রাঞ্চ ও উইন্ডো ভিত্তিক ইসলামিক ব্যাংকিং, ৩৪টি ইসলামিক বীমা বা তাকাফুল সেবা প্রতিষ্ঠান, ও ১৮-টি শরিয়াহ ফান্ডের সরকারি বিনিয়োগ পত্রে বিনিয়োগ করতে হলে সুকুকের বিকল্প নেই। এছাড়া ব্যক্তি পর্যায়ে অধিকাংশ মুসলিম শরিয়াহ সম্মত সঞ্চয় ও বিনিয়োগে আগ্রহী। অনেকে তাদের প্রভিডেন্ট/পেনশন/গ্রাচুইটি ফান্ড শরিয়াহ সম্মত ভাবে পরিচালিত হতে দেখতে আগ্রহী। এই বিশাল চাহিদা পূরণে পর্যাপ্ত ইসলামিক বিনিয়োগ পত্র বাজারে নেই। চাহিদার তুলনায় বাংলাদেশে সরকারি সুকুকের সরবারহ যে একেবারেই অপ্রতুল তা বুঝা যায় প্রচলিত ধারার একটি ব্যাংকের সাম্প্রতিক ঘটনা থেকে যেটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামিক হওয়ার অনুমোদন পাওয়ার পরেও অগ্রসর হতে পারেনি আকর্ষণীয় হার প্রদান করে এমন পর্যাপ্ত সরকারি সুকুক না থাকার কারণে।

বহুবিধ চাহিদাকে বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরণের সরকারি সুকুক ইস্যু করা সম্ভব। যেমন, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী। একটি নির্দিষ্ট সময় পর ইস্যুকারীর পক্ষে পুন-ক্রয়ের সুযোগ (কল অপশন) রেখে বা বিনিয়োগকারীর পক্ষে ইস্যুকারীর কাছে বিক্রয়ের সুযোগ (পুট অপশন) রেখে মেয়াদ বিহীন বা পার্পেচুয়াল সুকুকও ইস্যু করা যেতে পারে। সুকুকের রেট অফ রিটার্ন স্থির, পরিবর্তনশীল বা কোনো একটি বেঞ্চমার্কের ভিত্তিতে হতে পারে। সুকুক আয় ভিত্তিক ও আয় বিহীন প্রকল্পের জন্যও হতে পারে। অর্থাৎ, সুকুক গঠনের সম্ভাবনা বিস্তৃত ও সরকারের বিভিন্ন অর্থায়ন প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম। ফলে, বিদ্যমান সকল ধরণের সরকারি বিনিয়োগ ও সঞ্চয় পত্রের বিকল্প হিসেবে সুকুক ইস্যু করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে এক দিকে যেমন সরকারের অর্থের চাহিদা মেটানো সম্ভব, অন্য দিকে সরকারি বিনিয়োগ বা সঞ্চয় পত্রে বিনিয়োগে আগ্রহী সবার চাহিদা মেটানো সম্ভব। যাদের এই ধরণের বিনিয়োগ পত্রের চাহিদা নেই, সম বিনিয়োগ সুযোগ থাকার ফলে তাদের অন্তত কোনো ক্ষতি নেই। বরং, সরকারি প্রকল্পের অর্থায়নে ঋণ বা দায়-ভিত্তিক চুক্তির পরিবর্তে অংশগ্রহণমূলক চুক্তির প্রয়োগের মাধ্যমে দেশের জিডিপির তুলনায় দায়ের অনুপাতেও উন্নতি করা সম্ভব। ইসলামিক অর্থ ব্যবস্থার মুদারাবাহ ও মুশারাকাহ চুক্তিগুলো ব্যবহার করে এটি অর্জন সম্ভব।

সুকুকের মাধ্যমে সরকারি ব্যয়ে অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব কারণ সুকুক ইস্যু থেকে প্রাপ্ত অর্থের ব্যবহার ও সুকুকহোল্ডারদের আয়ের মধ্যে সরাসরি যোগসূত্র থাকার বাধ্যবাধকতার ফলে সুকুকহোল্ডারদের কাছে বিভিন্ন তথ্য প্রকাশ করতে হয়। যেমন, সুকুক ইস্যু থেকে প্রাপ্ত অর্থ যদি কোনো কিছু ক্রয়-বিক্রয়ে ব্যবহার করা হয়, তাহলে প্রকাশ করতে হয় যে কি ধরণের সম্পদ ক্রয়-বিক্রয় করা হবে। অর্থ যদি সম্পদ নির্মাণে ব্যবহার করা হয়, তাহলে প্রকাশ করতে হয় যে কি ধরণের সম্পদ নির্মাণ করা হবে ও নির্মাণ কাজ শেষ করতে কত সময় লাগবে। যদি সম্পদ ক্রয় করে ভাড়া দেয়ার কাজে অর্থ ব্যবহার করা হয় তাহলে প্রকাশ করতে হয় কি ধরণের সম্পদ ক্রয় করা হবে ও ভাড়ার পরিমাণ কত হবে। সুকুক ইস্যু করার পূর্বে যেমন কিছু তথ্য প্রকাশ করতে হয়, ইস্যু করার পরেও সুকুকের ধরণ ভেদে বিভিন্ন তথ্য প্রকাশ করতে হয়। প্রচলিত বন্ডের ক্ষেত্রে তথ্য প্রকাশের এমন বাধ্যবাধকতা থাকে না।

এখন পর্যন্ত ইস্যুকৃত প্রতিটি সরকারি সুকুকের বিপরীতে সুনির্দিষ্ট প্রকল্প চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন, প্রথমটি ইস্যু করা হয় সমগ্র দেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্পের অর্থায়নে। দ্বিতীয়টি ইস্যু করা হয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রয়োজন ভিত্তিক অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থায়নে। তৃতীয়টি ইস্যু করা হয় গুরুত্বপূর্ণ গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থায়নে। চতুর্থটি ইস্যু করা হয় চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন উপজেলা ও ইউনিয়নে রাস্তা প্রশস্ত-করণ এবং শক্তিশালী-করণ প্রকল্পের অর্থায়নে। প্রতিটি সুকুকের প্রকল্প বাছাইয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেবট ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টে একটি ভূমিকা রেখেছে। তারা অতি সংক্ষিপ্ত পরিসরে হলেও সুকুক ইস্যুর পূর্বে প্রকল্পগুলোর উপযুক্ততা যাচাই করেছে ও প্রকল্প পরিচালকের সাথে কথা বলেছে। সুকুক ইস্যু করার পরে প্রকল্পের অগ্রগতির বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছে ও ক্ষেত্র বিশেষে সরেজমিন পরিদর্শন করেছে। এছাড়া তারা সুকুকের জন্য একটি টেকনিক্যাল কমিটি ও একটি শরিয়াহ কমিটি গঠন করেছে যেখানে সুকুকের কাঠামো ও শরিয়াহ বিষয়গুলোর পাশাপাশি প্রকল্পের বিভিন্ন দিকও আলোচনা করা হয়েছে। প্রতিটি সুকুকের জন্য প্রসপেক্টাস প্রস্তুত করা হয়েছে যেখানে প্রকল্প ও সুকুক অর্থের ব্যবহার বিষয়ক একটি ধারণা দেয়া হয়েছে, যা সবার জন্য উন্মুক্ত। এসকল পদক্ষেপ প্রচলিত বন্ডের মাধ্যমে উত্তোলিত অর্থ দ্বারা বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে বলা যায় থাকে না।

পদক্ষেপগুলোকে আরো শক্তিশালী করার মাধ্যমে সরকারি প্রকল্পের মূল্যায়ন, বাস্তবায়ন ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় বড় ধরণের উন্নতি করা সম্ভব। পর্যাপ্ত তথ্য প্রবাহের মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব। সংশ্লিষ্টদের এখন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। বর্তমান সরকার যেহেতু সকল ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং একই ধরণের প্রতিশ্রুতি পরবর্তী সরকারগুলো থেকেও যেহেতু আমরা প্রত্যাশা করি, এটি অর্জনের একটি পদক্ষেপ হিসেবে প্রচলিত বন্ড বা অন্যান্য ঋণ-ভিত্তিক মাধ্যমের পরিবর্তে সুকুক ইস্যু করে সরকারি প্রকল্পে অর্থায়ন করার একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আসাটা সময়োপযোগী হবে।

এছাড়া সুকুকের মাধ্যমে সরকারি সম্পদের সাথে সরাসরি জন সম্পৃক্ততা সৃষ্টি করা সম্ভব। সুকুকের অর্থায়নে সৃষ্ট সম্পদ যেহেতু সুনির্দিষ্ট থাকে, সম্পদগুলোকে (যেমন, রাস্তা, বিদ্যালয়, নলকূপ, ইত্যাদি) সুকুক অর্থায়নে সৃষ্ট হিসেবে চিহ্নিত করার ব্যবস্থা থাকতে পারে। এর মাধ্যমে জনগণ অবহিত হবে তাদের অর্থ কোথায় ব্যবহার করা হয়েছে, যা সরকারি সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ ও যত্ন নেয়ার একটি মানসিকতা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়া, এর মাধ্যমে কিছু জনপ্রতিনিধির নিজের টাকাতে কাজগুলো হচ্ছে বলে যে একটি ধারণা দেয়ার চেষ্টা বিদ্যমান তা কিছুটা হলেও হয়ত নিয়ন্ত্রিত হবে। নতুন বাংলাদেশে আমরা সচেতন জনগোষ্ঠী প্রত্যাশা করি। কিন্তু, সচেতন হওয়ার সুযোগটা তাদের দিতে হবে।